এমন জালিয়াতি করে চাকরি নেওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল বিস্ময়কর তথ্য। কোনোভাবে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি হলে কাজে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ‘খুশি’ করতে পারলে কাজ না করেও চাকরি টিকিয়ে রাখা যায়। এই সুযোগ নিতেই অনেকে টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। তাঁদের একটি অংশ কাজ না করেই বেতন নিয়ে থাকেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে দুভাবে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ করা হতো। একটি হচ্ছে বিভাগীয় ব্যবস্থায়। আরেকটি হলো সাচিবিক আদেশে তথা মেয়রের অনুমোদন নিয়ে। বিভাগীয় ব্যবস্থায় নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কারও চাকরি শেষ হয়ে গেলে, কেউ অসুস্থতার কারণে কাজে অক্ষম হলে বা কেউ মারা গেলে তাঁর বিকল্প হিসেবে সংস্থার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের আদেশে অন্য কাউকে এ কাজে নিয়োগ দেওয়া যেত। এভাবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে তথ্য খুব একটা যাচাই–বাছাই করা হতো না। এ সুযোগে অনেকেই বয়স লুকিয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি নিয়েছেন। তাঁরাই এখন চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির সচিব দপ্তর সূত্র বলছে, বর্তমানে সংস্থাটিতে ৫ হাজার ১৬৫ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজ করেন। এসব কর্মীর  বেশির ভাগেরই বেতন হয় দৈনিক কাজের ভিত্তিতে। এ সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার ৬২২ জন। তবে কর্মরত সবাই মাসের ৩০ দিনেই কাজ করছেন বলে দেখানো হচ্ছে। দৈনিক একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ৪৭৫ টাকা করে বেতন পান। মাসে এ টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ হাজার ২৫০ টাকা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডকে ভাগ করা হয়েছে ১০টি অঞ্চলে। প্রতিটি ওয়ার্ডেই আয়তন ও পরিস্থিতি বুঝে নিয়োগ করা হয়েছে পরিচ্ছন্নতাকর্মী। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের দৈনিক মজুরিভিত্তিক পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের পরিচয়পত্র প্রদানের জন্য দক্ষিণ সিটি অবশ্য একটি কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটির তথ্য বলছে, ইতিমধ্যে তাঁরা দুটি অঞ্চলের সব কর্মীকে পৃথকভাবে ডেকে তথ্য যাচাই করেছেন। এর মধ্যে একটি অঞ্চলে কর্মরত ৭৯৬ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মধ্যে ৭০ জনের বয়স নিয়ে গরমিল পেয়েছেন। আরেকটি অঞ্চলে ৭৫ জন কর্মীর মধ্যে ২০ জনের তথ্যে অসংগতি পাওয়া গেছে।

এই কমিটির একাধিক সদস্যের ধারণা, মোট কর্মীর মধ্যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ব্যক্তির বয়স নিয়ে তথ্যে গরমিল রয়েছে। ১৫ শতাংশ হিসাবে বয়স নিয়ে তথ্য গরমিল থাকা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৭৪ জন।

পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের তথ্য যাচাইয়ে গঠিত কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, পৃথকভাবে ডেকে আলোচনা করতে গিয়ে তাঁরা দেখেছেন অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে জন্মনিবন্ধন সনদের মিল নেই। জন্মনিবন্ধনে যে বয়স রয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্রে সেই বয়স উল্লেখ নেই। আবার বাস্তবে কারও বয়স ৬০–এর বেশি মনে হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর বয়স ৪৫ অথবা ৪৮ রয়েছে। অনেকের আবার একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী, ৫৯ বছর পর্যন্ত চাকরি করার বিধান থাকলেও অনেকের বয়স ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে।

পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরি নেওয়ার পর কাজ না করে বেতন তোলার তথ্য পাওয়া গেল সংস্থার সাবেক এক কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখেছেন কাগজে–কলমে তাঁর ওয়ার্ডে অন্তত ১২০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন। কিন্তু রাস্তাঘাট সেভাবে পরিষ্কার থাকছে না। বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছেন মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন কেবল ৩০ জন।

যাচাই–বাছাই কমিটিতে থাকা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে বাকি আটটি অঞ্চলের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন।

এ কমিটির আহ্বায়ক ও অঞ্চল-১–এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীন বলেন, কাজ করতে পারলে আগে যে কাউকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নেওয়া হতো। তখন চেহারা দেখে বয়স লিখে নেওয়া হতো। এখন এটি নিয়মের মধ্যে এসেছে। তিনি বলেন, ‘অনেকের বয়স ৫৯ বছরের বেশি। শারীরিক অক্ষমতার কারণে তাঁরা কাজ করতে পারছেন না। যাচাই–বাছাই করে যাঁদের বয়স বেশি, তাঁদের বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here