১৪ দলের শরিকদের নানা অভিযোগ ছিল কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সখ্যতা নিয়ে। তবে আওয়ামী লীগ  বিভিন্ন  সময় বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দল এবং সংগঠনের সঙ্গে একটা সম্পর্ক রেখে চলার চেষ্টা করেছে।

এখন নির্বাচন সামনে রেখে ১৪ দলের বাইরে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদার তৃণমূল বিএনপি, ইসলামি ঐক্যজোটের একটি অংশসহ কিছু ধর্মভিত্তিক দলকে কাছে টানার তৎপরতা বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। এই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ নামের একটি দলের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের বেশ ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ধর্মভিত্তিক এই দলটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইসলামিক ফ্রন্ট নামের দলটি অনেক দিন ধরে ১৪ দলীয় জোটে অন্তর্ভূক্ত হতে চাইছে এবং চেষ্টা চালাচ্ছে। এই দলের আগ্রহের বিষয়ে আওয়ামী লীগও তাদের জোটের বৈঠকে আলোচনা করেছে।  সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর ইস্কাটনে ১৪ দলের এক বৈঠকে জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি তোলেন। তখন শরিক দলের একাধিক শীর্ষ নেতা নেতিবাচক মনোভাব দেখান। এরপর আলোচনা আর এগোয়নি।

ইসলামিক ফ্রন্টের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী মুক্তির মিছিলকে বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ১৪ দলে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তারা।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেছেন,  বিরোধীদল বিএনপি তাদের পুরোনো ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে, অনেক দল নিয়ে কয়েকটি জোট গঠন করে সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করছে। আওয়ামী লীগও  বেশি সংখ্যক দলকে কাছে টেনে তাদের বড় ঐক্য দেখাতে চাইছে।

তবে অন্য দলকে বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক দলকে ১৪ দলে অন্তর্ভূক্ত করার ক্ষেত্র দীর্ঘদিনের শরিকদের সঙ্গের সম্পর্কের টানাপোড়েনে সৃষ্টি হতে পারে। এই বিষয়টিও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিবেচনায় নিতে হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তাদের পাশে থাকবে, এমন নতুন দলকে নিয়ে ১৪ দলীয় জোট বড় করার চেষ্টা তাঁরা চালিয়ে যাবেন। তবে শেষপর্যন্ত পুরোনো শরিকদের রাজি করানো সম্ভব না হলে তারা অতীতের মত নির্বাচনী জোট বা মহাজোট করার বিষয়ও আওয়ামী লীগের ভেতরে আলোচনায় রয়েছে।  এমনকি ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে দিয়ে আলাদা একটি জোট করার বিষয়েও সরকারের ভেতর থেকে তৎপরতা আছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪ দলের সমন্বয়ক এবং আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু মুক্তির মিছিলকে বলেন, নানা দল আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ১৪ দলের বাইরে অন্য দলের সাথে ঐক্য কীভাবে হবে–তা আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে।

শরিকদের আপত্তি কেন

আওয়ামী লীগের পুরোনো একাধিক শরিক দলের সূত্র বলছে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কিংবা বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) মতো কেউ জোটে আসতে চাইলে তাদের ইতিবাচকভাবে দেখা হবে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক দলকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে শরিকদের আপত্তি থাকবে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোট গঠিত হয় ২০০৪ সালে। ২০০৫ সালে ১৪ দলের পক্ষ থেকে ৩৩ দফা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সেখানে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়াসহ নানা বিষয় ছিল।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি (জেপি) ও তরিকত ফেডারেশন জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১৪ দলের অন্যতম শরিক জাসদ ভেঙে  জাসদ এবং বাংলাদেশ জাসদ নামের দু’টি দলের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ জাসদ ওই জোট থেকে বেরিয়ে যায়।

১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ, জাসদ, ন্যাপ (মোজাফফর) ও বাম জোটের ১১টি দল নিয়ে। এরপর বিভিন্ন সময় জোট থেকে কিছু দল বেরিয়ে গেছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে কিছু দল। তবে জোটে দলের সংখ্যা যা–ই হোক না কেন এটি ১৪ দলীয় জোট হিসেবেই বহাল আছে।

১৪ দলের একটি শরিক দলের শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুক্তির মিছিলকে বলেন, জোটে সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ নয়। এ ধরনের তৎপরতা চালানো হয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে সরকারের অন্য দিক থেকে।

শরিক দলের ওই নেতা মনে করেন, কোনো কোনো দল নিজ থেকে ১৪ দলে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। আবার সরকারের বিভিন্ন দিক থেকেও নির্দিষ্ট কিছু দলকে ক্ষমতাসীনদের জোটে ভিড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। জোট সম্প্রসারণের চিন্তার পেছনে এই দুই ধরনের প্রক্রিয়া কাজ করছে। যা পুরোনো জোটে শরিকদের সঙ্গে টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মুক্তির মিছিলকে বলেন, ১৪ দলকে তো আর ১৪০ দল বানানো যাবে না। ১৪ দলে যারা আছে, তারা তো দীর্ঘদিন ধরেই আছে।

আরও যাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের আগ্রহ

সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা বিএনপি ছাড়ার পর থেকেই ক্ষমতাসীনদের জোটে থাকার চেষ্টা করছেন। দলটিকে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন দেওয়ার জন্য সম্প্রতি আদালত থেকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই দলের সঙ্গে আওয়ামী রীগের যোগাযোগ রয়েছে।

এছাড়া কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে ১৪ দলীয় জোটে নিতে চায় আওয়ামী লীগ। তবে কাদের সিদ্দিকী নিজে আওয়ামী লীগে যেতে আগ্রহী বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তাঁকে দলে না নিয়ে ১৪ দলীয় জোটে নিতে চায়। এই বিষয়ে জোটের শরিকেরা খুব বেশি রাজি না হলেও একেবারে নাকচ করে দেয়নি।

কাদের সিদ্দিকী ২০১৮ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক হিসেবে ভোটে অংশ নিয়েছিলেন। সেই নির্বাচনের পরে অবশ্য তিনি ওই জোট থেকে বেরিয়ে আসেন। এতদিন কাদের সিদ্দিকী কিছুটা চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু গত ২৩ ডিসেম্বর হঠাৎ করে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে ক্ষমতাসীন জোটে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর  ১৪ দল কিংবা আওয়ামী লীগে যোগদানের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে কাদের সিদ্দিকী মুক্তির মিছিলকে বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই।’

তবে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন,  ১৪ দল সম্প্রসারণ হবে নাকি মহাজোট হবে–এ বিষয়টি পরিস্কার হবে আগামী ঈদুল ফিতরের পরে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here