মুক্তির মিছিল, ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৩ : শিক্ষার্থীর তথ্যসংক্রান্ত ফরম পূরণের সময় অভিভাবক হিসেবে মায়ের নামও লেখা যাবে—হাইকোর্টের এ রায়ে আনন্দিত এবং আপ্লুত হওয়ার কারণ আছে। এখন থেকে কারও বাবা না থাকলে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে বাবার পরিচয় ব্যবহার করতে না চাইলে মা কিংবা আইনগতভাবে অন্য কোনো অভিভাবকের নাম যুক্ত করতে পারবেন বলে যে রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট, একে সভ্যতার পথে, ন্যায্যতার পথে আরও এক ধাপ এগোনোর সমতুল বলে মনে করি। এবার সরকারকে এ রায় কার্যকর করতে নির্দেশনা দিতে হবে। নইলে এ রায় জেনে নিয়ে যেসব স্কুল, কলেজ কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার ফরম পাল্টে যাবে আর মায়ের নাম গ্রহণে রাজি হবে, এমন ভাবার কারণ নেই।

হাইকোর্টের এ রায় যুগান্তকারী। তবে ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো অবৈধ ঘোষণা দিয়েও মহামান্য হাইকোর্টের রায় আছে বটে! কাজেই রায় ‘যুগান্তকারী’ হলেই যুগ পাল্টে যায় না বরং রিটের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া উচ্চ আদালতের রায় কার্যকর করতে এরপর সরকার এবং প্রশাসনের পদ্ধতিগতভাবে কাজ করতে হয়। সরকারের ওপর উচ্চ আদালতের রায় কার্যকরের দায়িত্বও থাকে। তবে সে দায়িত্বে অবহেলা করলে আদালতে ডেকে সাধারণত কাউকে যেহেতু আমরা জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে দেখি না, কাজেই আদালতের ভালো সিদ্ধান্ত সংবাদের শিরোনাম হয়ে কয়েক দিনের আলোচনাতেই আটকে থাকবে, এমন আশঙ্কার যুক্তিসংগত কারণ আছে।

এর আগেও হাইকোর্ট রিটের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ‘যুগান্তকারী’ রায় দিয়েছেন। যেমন ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত রায় দিলেন সব কর্মক্ষেত্র আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি করতে হবে। তার কোনো ফল এখনো দেখা যায়নি। সেই রায়েরও ১০ বছর পর ২০১৯ সালে অধ্যক্ষের যৌন নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে পুলিশ প্রশাসন পর্যন্ত যাওয়ার ফলশ্রুতিতে নুসরাতকে তাঁরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।

ইচ্ছার অধিকার

মনে রাখতে হবে, কেবল ‘পিতৃপরিচয়হীন’দের জন্য এ রায় নয়। কেউ যদি পিতার নাম ব্যবহার করতে না চায়, তাদের সবার জন্য এ আইন। এ রায়ের একটা বড় প্রগতিশীলতা, প্রাগ্রসর চিন্তা এখানে টের পাওয়া যায়। কাজেই শুধু ‘পিতৃপরিচয়হীন’ ধরনের সেকেলে এবং অসংবেদনশীল শব্দ এ রায়ের ব্যাখ্যায় ব্যবহার করলে তা এ রায়ের মূল চেতনার বিরোধী হবে বলে আমার মনে হয়। আইনগত অভিভাবকের নামও লেখা যাবে বলে রায়ে আছে। তার মানে যিনি অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁকেই সনদে রাখার সভ্য চিন্তার উদ্রেক করতে চেয়েছে এ রায়। কাজেই এ রায় অনুসারে সেই সম্তানেরাও এর সুবিধা পাবেন, যাঁদের ‘পিতৃপরিচয়’ আছে কিন্তু তাঁরা পিতার পরিচয় দিতে চান না। রায় অনুসারে, পিতৃপরিচয় দিতে কাউকে আর বাধ্য করা যাবে না।

আবার, ‘পিতৃপরিচয়হীন’ কারা, সে সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মামলার আবেদনকারীরা বলেছেন, যৌনকর্মীর সন্তান, সারোগেসি বা আইভিএফ প্রযুক্তির মাধ্যমে জন্মগ্রহণকারী সন্তান, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ঔরসজাত সন্তান, বাবা কর্তৃক পরিত্যক্ত সন্তান বা বাবার পরিচয় দিতে না পারা সন্তানদের পিতৃপরিচয়হীন সন্তান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এটাও দারুণ আশাব্যঞ্জক যে এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সারোগেসির মাধ্যমে কেউ যদি একক সিদ্ধান্তে সন্তান নেন, তাঁর ইচ্ছার অধিকারকেও অন্তর্ভুক্ত করার একটা আইনি আলোচনার সূচনা হলো।

এ রায় যেহেতু অভিভাবকত্ব আইনে তাৎক্ষণিক কোনো বদল আনেনি, সেহেতু অনেকেই হতাশ হচ্ছেন। ফরমে অভিভাবকের ঘরে বাবার বদলে মায়ের নাম লেখায় ২০০৭ সালে পরীক্ষা দিতে না পারা রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের এক শিক্ষার্থীর খবরের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে ব্লাস্ট, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং নারীপক্ষ এ তিন অধিকার সংগঠন স্টুডেন্ট ইনফরমেশন ফরম বা এসআইএফে (যে ফরমে শিক্ষার্থীর পরিচয়সংক্রান্ত তথ্য উল্লেখ থাকে) অভিভাবকের ঘরে শুধু বাবার নাম লেখার বৈষম্যমূলক বিধানটি চ্যালেঞ্জ করে রিট করে। আমার মনে হয়, এরপর দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে যে রিটের পক্ষে ওই তিন সংগঠন আইনি লড়াই চালিয়ে গেছে, তার একটা অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য

ছিল। সেটা হলো এর পক্ষে একটি রায় আনার মাধ্যমে অভিভাবক হিসেবে মা কে (সন্তানের ইচ্ছা অনুযায়ী বাবার বদলে, বাবার নাম উল্লেখ না করেই) একটা দালিলিক ভিত্তি দেওয়ার সূচনা করা। মনে রাখতে হবে, এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার সনদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব পরিচয় শনাক্তকরণ দলিলে এ রায়ের ফলেই মায়ের নাম লেখার সুযোগ তৈরি হতে যাচ্ছে।

কেন এ রায় গুরুত্বপূর্ণ

এ রায়ের ফলে অবশ্যই আমাদের আইনি কাঠামোতে বাবাই যে একমাত্র এবং প্রকৃত অভিভাবক (ন্যাচারাল গার্ডিয়ান), সেটা পাল্টে যায়নি। বাংলাদেশের আইনে মা সন্তানের অভিভাবক নন, জিম্মাদার মাত্র, তা–ও কেবলই নাবালক সন্তানের। অভিভাবক এবং প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০-এর ১৭ [ক] ধারা অনুযায়ী, নাবালক সন্তানের জিম্মাদার করা হয়েছে মাকে আর বাবাকে অভিভাবক। ছেলেসন্তান সাত বছর পর্যন্ত আর মেয়েসন্তান বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকবে। কাজেই এখনো অনেক সন্তান ফেলে চলে যাওয়া বাবা যখন মায়ের জিম্মাদারির মেয়াদ পেরোনোর পরেই সন্তান ছিনিয়ে নিতে আসেন, তখন মায়েদের সন্তানের জিম্মাদারিটুকু অন্তত ধরে রাখতে আইনি লড়াইয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না। ওই আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সময়েও সন্তান না চাইলেও তাকে বাবার হাতে তুলে দিতে হয়। কারণ, আমাদের আইন সন্তানের জিম্মাদারি এবং অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে এতই বাবামুখী যে আদালতের নির্দেশ ছাড়া সন্তানের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়ারও কোনো সুযোগ সেখানে থাকে না।

এ কারণেই বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ২৪ জানুয়ারি যে রায় দিয়েছেন, সেটি আমার কাছে অত্যন্ত সচেতনভাবে প্রগতিবাদী এবং তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। এ রায়ে সন্তানের ইচ্ছার ওপর স্পষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রায় অনুসারে, কোনো শিক্ষার্থীকে তার পিতার পরিচয় দিতে বাধ্য করা যাবে না। শিক্ষার্থী তার ইচ্ছেমতো বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম দিতে পারবেন। এবং এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে যেহেতু স্কুল এবং এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফরমকে এর অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে, কাজেই রায়ে বিশেষভাবে অভিভাবকের সম্মান, নাম এবং দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে নাবালক সন্তানের ইচ্ছাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি সচেতনভাবেই স্পষ্ট করেছেন আদালত।

এ রিটের মূল ঘটনাটি যদি মনে করি তাহলে, কেন এ রায় এতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এর ফলে অন্তত শিক্ষা ক্ষেত্রের ফরমে যে কত বড় মানবিক মর্যাদা রক্ষাকারী পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা এর মাধ্যমে আদালত দিলেন, তা স্পষ্ট হবে। ২০০৭ সালের ২৮ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় ‘বাবার পরিচয় নেই, বন্ধ হলো মেয়ের লেখাপড়া’ শিরোনামে যে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল, সেখানে ওই শিক্ষার্থী বলেছিলেন, যদিও তিনি জানেন তাঁর বাবা কে, তবু তিনি তাঁর সেই বাবার নামটি এসএসসির নিবন্ধন ফরমে লিখতে চাননি। কারণ, ওই লোকটি তাঁকে বা তাঁর মাকে কখনো স্বীকৃতি দেননি। সবাই তাই ওই লোকটির নাম অভিভাবকের ঘরে লিখে দিতে বললেও তিনি লেখেননি এবং ফলশ্রুতিতে নিবন্ধনপত্র এবং প্রবেশপত্র না পেয়ে পরীক্ষাও দেওয়া হয়নি ওই শিক্ষার্থীর।

এই যে সন্তানের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন না করা, এমনকি সামাজিক স্বীকৃতিটুকুও দিতে অনিচ্ছুক পিতা শুধু পিতা হওয়ার জোরে অভিভাবকের স্বীকৃতি পেয়ে যান; যে সন্তানকে চির অসম্মান এবং অনাদরে ফেলে রাখেন, সেই সন্তানকেই যে সমাজের ব্যবস্থায় টিঁকে থাকতে বা এ ক্ষেত্রে পরীক্ষায় বসতে বাবা হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে ওই ব্যক্তিকে স্বীকৃতি দিতে হয়, সে অন্যায্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম উল্লেখ করে নিবন্ধনসহ শিক্ষাক্ষেত্রে সব ফরম পূরণ করা যাবে।

অভিভাবকত্ব আইনে বদল আনার প্রচেষ্টার সূচনা

পারিবারিক আইনে বদল আনা, বিশেষ করে যার সঙ্গে সামাজিক বিশ্বাস এবং প্রথা (অনেক ক্ষেত্রেই তা পুরোনো অন্ধবিশ্বাস এবং কুপ্রথা) বদলের সম্পর্ক রয়েছে, তা কত কঠিন তা আমাদের আইনি কাঠামোর বৈষম্যমূলক যেকোনো আইন থেকেই ধারণা করা যায়। প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো সন্তানের অভিভাবকত্ব আইনে বদল আনার প্রচেষ্টার একটা সূচনা বলা যেতে পারে এই রায়কে। বাবা বা মা কাউকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে নয়, বরং সভ্য সমাজে বহু বছর ধরে যে চর্চা চলে আসছে, সন্তান বা শিশু যেখানে চাইবে যাকে অভিভাবক বলে চাইবে তার কাছেই যাতে সে থাকতে পারে, সেভাবে বাংলাদেশের অভিভাবকত্ব আইনে বদল আনা এখনকার সমাজবাস্তবতায় খুব জরুরি।

এ রায়ে উচ্চ আদালতের যে মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তা ব্যাখ্যা করে, এ রায়কে নজির (প্রিসিডেন্স) ধরে আগামী দিনে অনেক মায়ের, সন্তানের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে, সন্তানের অভিভাবকত্ব বা জিম্মাদারি দাবি করা সহজতর হবে বলে আশা করা যায়।

উচ্চ আদালতের প্রগতিবাদী মনোভাব পৃথিবীর অনেক নিবর্তনমূলক আইন বদলে বছরের পর বছর ধরে চলা সামাজিক আন্দোলন এবং আইনি লড়াইকে একই সঙ্গে জোরদার করে এসেছে। সে কারণে আইনের পরিসরে আদালতের আন্দোলনবাদিতা বা জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজম বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। কোনো দেশের বর্তমান আইনি কাঠামোতে না থাকলেও ন্যায্যতার প্রশ্নে এবং আইনের চোখে সবাই সমান এ ধারণার বশবর্তী হয়ে যখন সে দেশের আদালত আইনের বই–পুস্তকের বাইরে গিয়ে কোনো প্রচলিত প্রথা বা চর্চাকে অবৈধ বা বেআইনি বলেন, সেগুলোকে জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের উদাহরণ বলা যেতে পারে। যেমন ১৯৫৪ সালে মার্কিন আদালত (ব্রাউন বনাম বোর্ড অব এডুকেশন) রায় দিলেন যে সাদা এবং কালো বর্ণের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা স্কুলের প্রথা বেআইনি। এরপর দশকের পর দশক ধরে বর্ণ বৈষম্যবিরোধী সামাজিক আন্দোলন এবং আইনি লড়াই চলতে চলতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ডে ২০১৬ সালে আরেক মামলার ফয়সালা হয়ে বর্ণের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র সর্বশেষ স্কুলটি যখন তার বৈষম্যমূলক চর্চার অবসান ঘটাল, তখন এ দাবিতে ১৯৬৫ সালে মামলা করা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া বাদীর বয়স ৫৭ বছর।

আইনের বদল খুব কঠিন বিষয়। এ ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’ পার হওয়ার পথে প্রতিটি জয় গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সমাজের প্রগতিবাদী মানুষের এসব রায়কে উদ্‌যাপন করে নানা পর্যায়ে এর সর্বোচ্চ কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে ক্রমাগত চাপ জারি রাখা। সমাজমানস এবং আইনের পরিবর্তনে আদালতে, পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে যাওয়া এবং সমতা প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ে শক্তি ধরে রাখাও সমাজের প্রগতিবাদী পক্ষের জন্য জরুরি। পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ, তবে সম্ভব। ইতিহাস বলে, আদালতকে সে ক্ষেত্রে পাশে পাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের উচ্চ আদালত একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মানবিক মর্যাদার পক্ষে, সমতার পক্ষে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তা উদ্‌যাপন করতেই হবে, আগামীর লড়াইয়ের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here