এই ঘটনার পরপরই বিএনপিকে কিছুটা অগোছালো মনে হয়। দলীয় অফিসে হামলা এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতা–কর্মীদের গণহারে আটকের পর কোনো শক্তিশালী কর্মসূচি ঘোষণা করেনি বিএনপি। ৭ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একা একা কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে ফুটপাতে অসহায়ের মতো বসে ছিলেন। এ সময় অন্য কোনো নেতা–কর্মীকে তাঁর পাশে দেখা যায়নি। অথচ বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর ঢাউস আকারের কমিটি হয়। ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষের কমে কোনো কমিটি হয় না। দলের সংকটময় মুহূর্তে এসব কমিটির সদস্যরা কোথায় ছিলেন, তা কেউ জানেন না।

১০ ডিসেম্বর পল্টন থেকে সমাবেশ সরিয়ে নিয়ে বিএনপি মূলত আওয়ামী লীগের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক খেলায় হেরে যায়। গোলাপবাগে বড় সমাবেশ হলেও এটা বিএনপির চেয়ে সরকারের সফলতা বেশি ছিল। সরকার বা আওয়ামী লীগ এই ঘটনায় প্রমাণ করতে পেরেছে যে তারা যেভাবে চেয়েছে, বিএনপি সেভাবেই সমাবেশ করেছে।

মূলত, ১০ ডিসেম্বেরকে ঘিরে সরকার ও প্রশাসনে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা অনেকটাই কেটে যায় গোলাপবাগে সমাবেশ সরিয়ে দেওয়ার পর। এর পর থেকেই সরকার বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং সরকার সমর্থকেরা প্রচার শুরু করেন, পরবর্তী নির্বাচনও তারা নিজেদের মতো করেই করবে।

রাজনীতির মাঠে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। না হলে রাজনীতির গতির সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন হয়ে যায়। মূলত নেতৃত্বের হযবরল অবস্থা, কোন্দল ও অযোগ্য ব্যক্তিদের গণহারের পদায়নের কারণে বিএনপির মধ্যে দ্বিধা–দ্বন্দ, শঙ্কা, ভয়, অনিশ্চয়তা প্রবলভাবে বিদ্যমান। তাই মহাসচিব আটক হওয়ার পর দলটি কর্মীদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশে বসেও আন্দোলন–সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দেওয়ার উদাহরণ ইতিহাসে অনেক আছে। এখন প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বা তার দল প্রযুক্তির সেই সুবিধা যথাযথভাবে নিতে পারছে না। চেয়ারখালি রাখা অনেক পুরোনো কৌশল। ডিজিটাল আমলে চেয়ার খালি রাখা কিছুটা হাস্যকরও বটে।

মনে হচ্ছে, বিএনপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কৌশলে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বিএনপির থিঙ্কট্যাংক নতুন নতুন আন্দোলনের কৌশল উদ্ভাবনে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার দমন–নিপীড়ন করছে। এটা আমরা সবাই বলি। কিন্তু এই দমন–নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বিএনপিকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। সহিংসতা না করেও সফল আন্দোলন করা যায়। প্রতিপক্ষের চাপ সব সময়ই রাজনীতিতে থাকবে। জনসমর্থন থাকার পরও বিএনপি এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে, বিএনপির নেতৃত্ব অনেকাংশেই একটি বিশেষ বিদেশি শক্তি ও প্রতিপক্ষের পক্ষের কবজায় চলে গেছে। এদের কাজ হচ্ছে ভয়ভীতি সঞ্চার করে বিএনপিকে আন্দোলন–সংগ্রাম থেকে দূরে রাখা। বাস্তবে হচ্ছেও তা–ই। ডিসেম্বরে বিএনপির মধ্যে যে গতি ছিল, তার অনেকটাই এখন থিতিয়ে গেছে। সামনে রোজা। ওই সময় আন্দোলন জমাতে পারবে না। তাই আবারও ঈদের পর আন্দোলনের গোলকধাঁধায় পড়ে যেতে পারে বিএনপি।

বিএনপি এর আগে অনেকবার বলেছে যে ঈদের পর আন্দোলন হবে। কিন্তু সেই ঈদ আর বিএনপির আসেনি। এ জন্য বিএনপিকে নিয়ে অনেক তামাশাও হয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বর–অক্টোবর নাগাদ দলটি চূড়ান্ত আন্দোলনে নামতে চায়। কোনোভাবে যদি ওই সময় পর্যন্ত বিএনপির আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ টেনে নিতে পারে, তাহলে যেকোনো প্রকারে নির্বাচন করে ফেলবে। কারণ, নভেম্বরেই তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। আর সেপ্টেম্বর–অক্টোবরেই যদি চূড়ান্ত আন্দোলন করা হয়, তাহলে এখন বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে সাধারণ কর্মীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? গত কয়েক মাসে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিএনপির ৯ কর্মী নিহত হয়েছেন।

প্রকৃতপক্ষে এ বছরের শেষ নাগাদ বিএনপি আন্দোলন করতে পারবে। কিন্তু ওই সময় পরিস্থিতির ওপর বিএনপির নিয়ন্ত্রণ না–ও থাকতে পারে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে নির্বাচন আটকানো এই বিএনপির পক্ষে সম্ভব হবে না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও পারেনি। এসব কারণে বিএনপির সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ আগে থেকেই আছে। এই সন্দেহ থেকেই শরিকদের অনেকেই সরকারের প্রলোভন বা চাপের মুখে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারে। ঐক্য ফ্রন্টে যোগ দেওয়াকে ভুল ঘোষণা করে কাদের সিদ্দিকী এখন নৌকার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার অপেক্ষোয় আছেন। এই প্রক্রিয়ায় অনেকেরই নাম শোনা যাচ্ছে। এমনকি বিএনপির অনেকেই দল থেকে বেরিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। উকিল আবদুস সাত্তার এর বড় উদাহরণ। আজ যাঁরা রয়ে–সয়ে আন্দোলন করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিএনপিকে, তাঁরা আসলে প্রতিপক্ষের হয়েই কাজ করছেন। এদের মূল কাজ হচ্ছে, বিএনপিকে বিভ্রান্ত করে সরকারকে গুছিয়ে নেওয়ার সময় করে দেওয়া। বিএনপিকে কোনোভাবে অক্টোবর পর্যন্ত টেনে নিতে পারলেই কেল্লাফতে।

বস্তুত, সুষ্ঠু নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করতে না পারলে বিএনপি দল হিসেবে টিকবে কি না, তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে। কোনোভাবে যদি আওয়ামী লীগ আবারও যেনতেন প্রকারে নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে যায়, তবে আরও শক্তভাবে বিএনপির ওপর চড়াও হবে। আর বিএনপির শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে, ভয়াবহ অস্তিত্বের সংকটে পড়বে বিএনপি। এমনকি রাজনীতি থেকে হারিয়ে যেতে পারে দলটি। বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আগামী নির্বাচন কীভাবে হবে, তার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করছে। সাধারণ মানুষ বর্তমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চান। একই সঙ্গে এটাও চান যে বড় দল হিসেবে বিএনপি জনসাধারণের এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিক। যদি বিএনপি তা না করতে না পারে, তাহলে সাধারণ মানুষ তাঁদের বিকল্প খুঁজে নেবে। অনন্তকাল ধরে নিশ্চয়ই কেউ অপেক্ষ করবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here